বর্তমানে সাইবার অপরাধের সংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাইবার অপরাধ
বন্ধ করতে হলে সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সাইবার অপরাধীদের অপরাধের ধরন
অনুযায়ী আপনি নিজেই জানতে পারবেন সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি কি।
বর্তমানে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সাথে সাথে অপরাধীরাও নিত্যনতুন বিভিন্ন
ধরনের প্রযুক্তি এবং কৌশল অবলম্বন করে অপরাধ করছে। কম্পিউটার ব্যবহার করে
ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগঠিত সকল ধরনের অপরাধই সাইবার অপরাধ। সাইবার অপরাধ থেকে
বাঁচতে হলে সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি কি জানতে হবে।
সূচিপত্রঃ- সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি
ভুমিকা
অন্যান্য দেশের প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও প্রযুক্তির ব্যবহার
ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ১৯৯৬ সালে ইন্টারনেট চালু
হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। এটি
অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটা গর্বের বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে
ইন্টারনেটের ব্যবহার দ্রুত পরিসরে বাড়ার ফলে ইন্টারনেট জগতে অপরাধের সংখ্যাও
দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন এবং সাইবার
অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি কি জেনে রাখুন।
সাইবার অপরাধ কি
সাইবার অপরাধ হলো ইন্টারনেট ভিত্তিক অপরাধ। সাইবার অপরাধের বিভিন্ন ধরন রয়েছে।
বর্তমানে আমরা সাইবার অপরাধ বলতে শুধু হ্যাকিংকেই বুঝে থাকি। কিন্তু শুধু
হ্যাকিং সাইবার অপরাধ নয়। ব্যাপক অর্থে সাইবার অপরাধ বলতে মোবাইল ফোন বা
কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধগুলোকে বোঝানো হয়।
আরো পড়ুনঃ সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালা ২০২৩
যেমন- কারো নামে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা. ব্যক্তির অনুমতি ছাড়াই তার গোপন
তথ্য ফাঁস করা. হ্যাকিং, জুয়া খেলা, প্রতিশোধ মূলক কাজ করা, মানসিকভাবে কাউকে
বিরক্ত করা, ক্রেডিট কার্ড তথ্য চুরি, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের
সিস্টেমে অনৈতিক প্রবেশ এবং অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে যে কোন ধরনের প্রতারণামূলক
কাজ সাইবার অপরাধের শামিল।
সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে
কম্পিউটার অথবা কম্পিউটার সিস্টেমের কোন ধরনের ক্ষতি করা, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে
স্প্যামিং ইমেইল পাঠানো, সিস্টেম ক্রাশ বা তথ্যচুরির উদ্দেশ্যে ভাইরাস ছড়ানো,
অন্য কারো সিস্টেমে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করা সবকিছুই সাইবার অপরাধ। এ ধরনের
সাইবার অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর
কারাদণ্ড ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কারো
কম্পিউটার সিস্টেমে প্রবেশ করার ফলে তথ্য নষ্ট, বাতিল অথবা পরিবর্তন এমনকি
সিস্টেমের কার্যকারিতা হ্রাস পায় অথবা কোন কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক সিস্টেম,
নেটওয়ার্কিং সিস্টেম এবং সার্ভারের অবৈধভাবে প্রবেশ করেন তাহলে এটিকে হ্যাকিং
হিসেবে ধরা হয়। সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি কি সেই হিসেবে হ্যাকিং এর
সর্বোচ্চ শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড বা ১
কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
আরো পড়ুনঃ সাইবার অপরাধ কি-সাইবার অপরাধের ধরণ
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ নিজ ইচ্ছাকৃত
নিজস্ব ওয়েবসাইট কিংবা অন্য কোন ওয়েবসাইট ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিংবা সোশ্যাল
মিডিয়ায় মিথ্যা অশ্লীল এবং অপ্রতিকর তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করে থাকে যার
ফলে কোন ব্যক্তির মান সম্মান হানি হয়, আইনশৃঙ্খলার ক্ষতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা
ব্যক্তির ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এ সকল কাজ ও সাইবার অপরাধের মধ্যে পড়ে। এ ধরনের
অপরাধের জন্য সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭
বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
বর্তমানে বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বাতিল করে, ‘সাইবার
নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন আইন প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। আইন
মন্ত্রীর তথ্য মতে, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ এ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
(ডিএসএ) এর সকল ধারায় বহাল থাকবে।
২৬ পৃষ্ঠার সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে,
‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ এ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) এর চেয়ে দুইটি
ধারা কম রয়েছে। নতুন এই ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ এইআইনে মোট ৬০টি ধারা
রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলোতে অপরাধ এবং সাজাসহ বিভিন্ন
বিষয় পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও প্রস্তাবিত এই আইনে দন্ড এবং
জরিমানা সংক্রান্ত বিষয়ে ৩১ টি ধারায় পরিবর্তন করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
এছাড়াও এই আইনে ১১ টি ধারায় সাজা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা
আইনে অপরাধ দ্বিতীয়বার করার দ্বিগুণ শাস্তির বিধান ছিল কিন্তু সাইবার
নিরাপত্তা আইনে সেটি থাকছে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বহুল আলোচিত ২৯ নম্বর ধারা সহ দুটি ধারায় শাস্তি
হিসেবে কারাদণ্ডের বিধান ছিল। বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইনে সে কারাদণ্ডের
বিধান বাতিল করে জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা নতুন এই
আইন প্রণয়ন নিয়ে খুব বেশি স্বস্তি দেখছেন না। তারা বলছেন, সাইবার নিরাপত্তা
আইনেও অনেক বিতর্কিত ধারা রয়ে গেছে। যার ফলে হয়রানির আশঙ্কা থেকে মুক্তি
পাওয়া সম্ভব নয়। তাদের মতে নতুন আইনের প্রয়োগ মানেই হলো পূর্বের আইন কে
প্রয়োগ করা। অর্থাৎ পূর্বের আইনটি নতুনভাবে প্রয়োগ হবে।
যা আছে নতুন আইনে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ নম্বর ধারা পরিবর্তন করে প্রস্তাবিত সাইবার
নিরাপত্তা আইনে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ নম্বর ধারা
অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল পদ্ধতিতে জাতির পিতা, বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার
বিরুদ্ধে কোনরকম গুজব, অপপ্রচার এবং প্রোপাগান্ডা চালায় বা সকল কাজে কেউ
সাহায্য করে তাহলে সে এই অপরাধে অপরাধী হতো এবং সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি
হিসাবে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান করা ছিল।
এবং কেউ যদি একই অপরাধে দ্বিতীয়বার অপরাধী হতো তাহলে তার সাজা দ্বিগুণ করার
বিধান ছিল। বারবার একই অপরাধ করার ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি
হিসাবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ৩ কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল। কিন্তু
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে
সাজার মেয়াদ কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। আবার দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করার
ক্ষেত্রে সাজা দ্বিগুণ হওয়ার আইনটিও বন্ধ করা হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ সেরা অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং কোর্স
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ নম্বর ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক বিতর্ক
থাকলেও সেই আইনের কোন পরিবর্তন করা হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৪ নম্বর
ধারা অনুযায়ী, একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি মনে করেন এই আইনের অধীনে কোন জায়গায়
অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিংবা সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এক্ষেত্রে সাক্ষ্য
এবং প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট করা, মুছে ফেলা, পরিবর্তন করা বা হওয়ার সম্ভাবনা
রয়েছে এক্ষেত্রে কোন পরোয়ানা ছাড়াই সেই পুলিশ কর্মকর্তা ওই স্থান তল্লাশি,
সরঞ্জাম জব্দ, ব্যক্তির দেহ তল্লাশি এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার
করার ক্ষমতা রয়েছে।
সাংবাদিক সহ বিভিন্ন মহল শুরু থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮, ২৯, ৩০
ধারাগুলো বাতিলের বিষয়ে কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রস্তাবিত
সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই সকল ধারাগুলো জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি, সংগঠন বা কোন
গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে বা
উস্কানি প্রদান করার জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এমন
কিছু তথ্য প্রচার বা প্রকাশ করে যার ফলে ধর্মীয় অনুভূতিতে কিংবা ধর্মীয়
মূল্যবোধে আঘাত আসে তাহলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সাইবার অপরাধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত
হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধান অনুযায়ী সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে
এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড, বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান
ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই অপরাধ বারবার করার ক্ষেত্রে সাজা ও জরিমানার
মেয়াদ দ্বিগুণ হওয়ার বিধান ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের 29 ধারায় বলা হয়েছে,
যদি কোন ব্যক্তি ওয়েবসাইট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ইচ্ছাকৃত মান সম্মান হানি
করে এরকম তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন তাহলে সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি
হিসাবে তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হতো।
এছাড়াও এই অপরাধ বারবার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার
বিধান ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই ধারা পরিবর্তন করে
কারাদণ্ডের সাজা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়। এই ধারায় শাস্তি হিসেবে শুধু
জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। এবং জরিমানা অনাদায় বা জরিমানা প্রদানে অপারগ
হলে সেক্ষেত্রে তিন মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক আজকে আমরা সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি কি সে সম্পর্কে জানলাম।
আশা করি আপনারা সাইবার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি গুলো জানার পরে যারা এরকম
ছোটখাটো সাইবার অপরাধ জেনে হোক বা নিজের অজান্তেই হোক করে থাকেন তারা সকলেই
সাইবার অপরাধ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন।